পৌরনীতি ও সুশাসন ২য় পত্র এইস এস সি ২০২২ সালের পরিক্ষার্থীদের অ্যাসাইনমেন্ট উত্তর/সমাধান ৭ম সপ্তাহ
(ক)ভাষা আন্দোলন ও যুক্তফ্রন্টঃ
ভাষা আন্দোলনঃ
বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষার মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করার আন্দোলন হচ্ছে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের তাৎপর্যপূর্ণ ভাষা আন্দোলন। ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমেই বাংলার জনগণের স্বাধিকার আদায়ের পদক্ষেপের সূচনা হয়। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগষ্ট পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হয়। পাকিস্তান সৃষ্টির পর পরই পূর্ব বাংলার জনগণের সাথে পশ্চিম পাকিস্তানীদের বৈষম্যমূলক আচরণ শুরু হয়। প্রথমে পশ্চিমা শাসক গােষ্ঠী বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতির উপর আঘাত নে। তারা বাঙালির মাতৃভাষার। অধিকার কেড়ে নিতে চায়। ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে পাকিস্তানের গভর্ণর জেনারেল মােহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকার পল্টন ময়দানে ঘােষণা করেন “উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা”। এ ঘােষনার পর পূর্ব বাংলার ছাত্র-জনতা বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। ভাষার দাবি প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের জন্য তারা সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে । ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি গণপরিষদ অধিবেশনে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্র ভাষা করার প্রস্তাব উত্থাপন করেন পূর্ব বাংলার সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত।
১৯৫২ সালের ২৬ জানুয়ারি ঢাকার পল্টন ময়দানে খাজা নাজিমউদ্দিন জিন্নাহর কথার পুনরাবৃত্তি করেন। ফলে ছাত্র-সমাজ তীব্র প্রতিবাদ শুরু করে। সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি সারা পূর্ব পাকিস্তানে ধর্মঘট আহবান ও বিক্ষোভ মিছিলের আয়ােজন করে। পুলিশ ছাত্রদের মিছিলের উপর গুলি চালায়। পুলিশের গুলিতে সালাম, বরকত, রফিক, সফিউর, জব্বারসহ কয়েকজন শহীদ হন। হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে পূর্ব বাংলা। শুরু হয় মাতৃভাষার অধিকার আদায় ও বাঙালি জাতির অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রাম। অবশেষে বাঙালি জাতি বুকের রক্ত দিয়ে মাতৃভাষাকে প্রতিষ্ঠিত করে। ভাষা আন্দোলন বাঙালির সাংস্কৃতিক আন্দোলন তাৎপর্য অত্যন্ত ভাষা আন্দোলন বিশ্বের ইতিহাসে এক বিরল স্থান দখল করে আছে। জাতিসংঘ ২১শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।
যুক্তফ্রন্টঃ
১৯৫৪ সালের নির্বাচন ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনের গুরুত্ব ও তাৎপর্য অপরিসীম। এ নির্বাচনের ফলে ভাষা আন্দোলনে সৃষ্ট বাঙালি জাতীয়তাবাদ সুদৃঢ় হয় এবং রাজনৈতিক স্বীকৃতি অর্জন করে। আর এ জাতীয়তাবাদী চেতনার ফসল হচ্ছে আজকের স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকেই পশ্চিমা শাসকগােষ্ঠী পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের প্রতি বিমাতা সূলভ আচরণ শুরু করে। ফলে এ অঞ্চলের মানুষের স্বাধীনতা ও উন্নয়ন নানাভাবে ব্যাহত হয়। পূর্ব বাংলার জনগনের মধ্যে প্রতিবাদ ও ক্ষোভ তীব্র হয়ে ওঠে। ১৯৪৬ সালের পর ১৯৫১ সালে প্রদেশগুলােতে নির্বাচন হবার কথা ছিল। কিন্তু পাকিস্তানী শাসক গােষ্ঠী পশ্চিম পাকিস্তানের প্রদেশগুলােতে নির্বাচন দিলেও পূর্ব বাংলাতে নির্বাচন দেয়নি। এর কারণ মুসলিম লীগের সম্ভাব্য পরাজয়ের ভয়।
১৯৪৮- ৪৯ সালে কয়েকটি উপনির্বাচনে পরাজয়ে তাদের মধ্যে ভীতির সঞ্চার হয়েছিল। ১৯৫৪ সালে পূর্ব বাংলায় প্রাদেশিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী এবং হােসেন সােহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে ২১ দফা কর্মসূচির ভিত্তিতে যুক্তফ্রন্ট গড়ে ওঠে। আওয়ামী লীগ, কৃষক প্রজা পার্টি, নেজামে ইসলাম এবং গণতন্ত্রী দল একজোট হয়ে ২১ দফা কর্মসুচিকে নিয়ে নির্বাচনে মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্ধিতা করে।
(খ) ৬ দফাঃ
১৯৬৬ সালের ছয় দফা বাঙালি জাতির জীবনে এক তাৎপর্যপূর্ণ অধ্যায়। ধর্মগত ঐক্যের ভিত্তিতে রাষ্ট্র তৈরি হলেও, পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে বাঙালিদের প্রতি বিমাতাসুলভ আচরণ করা হয়। অর্থনৈতিক উন্নয়ন, সামরিক-বেসামরিক চাকরি, শিক্ষা ও অন্যান্য ক্ষেত্রে বাঙালীদের প্রতি ক্রমবর্ধমান বৈষম্য দেখানাে হয়। পশ্চিম পাকিস্তানের এ পরিকল্পিত শােষণের হাতে থেকে মুক্তির জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি ঐতিহাসিক মুক্তির বাণী তথা ‘ছয় দফা কর্মসূচি পেশ করেন। আওয়ামী লীগের ছয় দফা ছিল ঐতিহাসিক দাবি। বাঙালির বাঁচা-মরার দাবি। এ ছয় দফা কর্মসূচি বাঙালিদের অ সনদ যার মধ্যে বাঙালিদের জীবনের দাবি নিহিত ছিল । নিম্নে ছয় দফা কর্মসূচি উল্লেখ করা হলঃ
১। শাসনতান্ত্রিক কাঠামাে ও রাষ্ট্রীয় প্রকৃতিঃ ১৯৪০ সালের ঐতিহাসিক লাহাের প্রস্তাবের ভিত্তিতে সংবিধান রচনা হবে। পাকিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসন হবে। সরকার হবে সংসদীয় পদ্ধতির, সর্বদলীয় ভােটাধিকারের ভিত্তিতে প্রাপ্ত বয়স্ক নাগরিকদের ভােটে কেন্দ্রীয় ও প্রাদেকি আইনসভা গঠিত হবে। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় আইনসভার জনসংখ্যানুপাতে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধিত্ব থাকবে।
২। পররাষ্ট্র সংক্রান্ত: বৈদেশিক সম্পর্ক ও প্রতিরক্ষা ছাড়া সকল বিষয় অঙ্গরাষ্ট্র বা প্রদেশের হাতে ন্যস্ত থাকবে। বৈদেশিক সম্পর্ক প্রতিরক্ষা বিষয় ন্যস্ত থাকবে কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে।
৩। অর্থ ও মুদ্রা: দেশের দুই অঞ্চলের জন্য দুটি পৃথক অথচ সহজে বিনিময়যােগ্য মুদ্রা চালু করার ব্যবস্থা থাকবে। এ রকম ব্যবস্থা চালু সম্ভব না হলে দুই অঞ্চলের জন্য একই মুদ্রা থাকবে, তবে সংবিধানে এমন ব্যবস্থা রাখতে হবে যাতে এক অঞ্চলের মুদ্রা অন্য অঞ্চলে পাচার না হতে পারে।
৪। শুল্ক সম্বন্ধীয়: সকল প্রকার ট্যাক্স, খাজনা ও কর ধার্য এবং আদায়ের ক্ষমতা প্রাদেশিক বা আঞ্চলিক সরকারের হাতে থাকবে। কেন্দ্রীয় সরকারের ব্যয় নির্বাহের জন্য আদায়কৃত অর্থের একটা অংশ কেন্দ্রীয় সরকার পাবে।
৫। বৈদেশিক বাণিজ্য বিষয়ক ক্ষমতা: বৈদেশিক মুদ্রার ওপর প্রদেশ বা অঙ্গরাজ্যগুলাের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকবে। বৈদেশিক বাণিজ্য ও সাহায্য সম্পর্কে প্রদেশ বা অঙ্গরাজ্যগুলাের সরকার আলাদা আলােচনা বা সম্পর্ক করতে পারবে।
৬। আঞ্চলিক সেনাবাহিনী গঠনের ক্ষমতা: আঞ্চলিক সংহতি ও জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষার কার্যকর ব্যবস্থা হিসেবে প্রদেশ বা অঙ্গরাজ্যগুলাে আধা-সামরিক বাহিনী বা মিলিশিয়া বাহিনী গঠন করতে পারবে।
(গ) ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানঃ
১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের অন্যতম সােপান। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকেই বাংলার জনগণ শােষিত হতে থাকে। ১৯৫৬ সালের সংবিধানে পূর্ব বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তান নাম দেয়। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান সামরিক শাসন জারির মাধ্যমে গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করে ও ভােটাধিকার কেড়ে নিয়ে তথাকথিত ‘মৌলিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে। ১৯৬২ সালের সংবিধানে সংসদীয় গণতন্ত্রকে উচ্ছেদ করা হয়। ১৯৬৮ সালে আইয়ুব সরকারের এক দশক স্মরণীয় করে রাখার জন্য ‘উন্নয়ন দশক পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ *রৈ। বাঙালিদের কাছে এটা ছিল। প্রহসন। কারণ আইয়ুবের দশ বছরে পূর্ব পাকিস্তানে তেমন কোন উন্নয়ন হয়নি। ফলে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ এটা মেনে নিতে পারেনি। তাদের পক্ষে নীরব থাকা সম্ভব ছিল না। তারা আন্দোলন করে আইয়ুব খানের বৈষম্য নীতির বিরুদ্ধে, আগরতলা মামলার বিরুদ্ধে, ১১ দফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে। ১৯৬৯ সালের জানুয়ারি মাস থেকে গণআন্দোলন শুরু হয়। এক পর্যায়ে গণআন্দোলন গণঅভ্যুত্থানে পর্যবসিত হয়।
গণঅভ্যুত্থানের কারণঃ
১. বৈষম্যনীতিঃ আইয়ুব সরকার সব সময় দুই অঞ্চলের মধ্যে বৈষম্য নীতি প্রয়ােগ করে। বস্তুত: পাকিস্তান রাষ্ট্রের সূচনা থেকেই এই বৈষম্য চলতে থাকে। পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মের সময় রাজধানী ছিল করাচী। আইয়ুব সরকার রাজধানী পরিবর্তন করেন ইসলামাবাদ। এ শহরের উন্নয়নের জন্য ব্যয় হয়েছিল। বিপুল অঙ্কের অর্থ । আর পাকিস্তানের দ্বিতীয় রাজধানী ঢাকার উন্নয়নের ব্যয় হয় নামে মাত্র অর্থ। সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও শিক্ষা ক্ষেত্রে বৈষম্য ছিল প্রবল। কৃষি, চিকিৎসা, বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা কেন্দ্রের ১৬টির মধ্যে মধ্যে ১৩টি পশ্চিম পাকিস্তানে ছিল।
২. মৌলিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা: সর্বজনীন ভােটাধিকারের পরিবর্তে তথাকথিত মৌলিক গণতন্ত্রীদের মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন, কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হওয়ায় সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন হয় না। এর ফলে মৌলিক গণতন্ত্রীদের ভূমিকা ক্রমাগত বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং জনগণের সঙ্গে সরকারের দূরত্ব সৃষ্টি হয়। এমতাবস্থায় সর্বত্র জনগণ সরকার পরিবর্তনের জন্য সােচ্চার হয় এবং তাদের পূঞ্জীভূত ক্ষোভ গণঅভ্যুত্থান ঘটায়।
৩. সামরিক শাসন: ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান সামরিক আইন জারি করে গণতান্ত্রিক পথ রুদ্ধ করেছিলেন। তিনি বিভিন্ন অধ্যাদেশের মাধ্যমে রাজনীতি ও বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মকান্ড নিষিদ্ধ করেছিলেন। বাংলা ভাষা, বাংলা বর্ণ, রবীন্দ্র সঙ্গীতসহ বাঙালি সংস্কৃতির নানা দিকে আঘাত হেনে বাংলাকে একটি সাম্প্রদায়িক অঞ্চলে পরিণত করতে চেয়েছিলেন।
৪. আগরতলা মামলা : ১৯৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলনের কারণে শেখ মুজিবুর রহমান আটককৃত অবস্থায় পাকিস্তান সরকার মামলা দায়ের করে। সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে এই মামলার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। হরতাল, বিক্ষোভ, আন্দোলন পূর্ব পাকিস্তানকে উত্তাল করে তােলে।
৫. স্বায়ত্তশাসনের দাবি: ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ চলাকালীন পূর্ব পাকিস্তানের উপর পশ্চিম পাকিস্তানীরা যে উদাসীনতা দেখিয়েছিল তার প্রতিক্রিয়াতে পূর্ব পাকিস্তানীরা স্বায়ত্বশাসনের দাবি তােলে। এ কারণে পশ্চিম পাকিস্তানীরা শেখ মুজিবসহ শত-শত নেতা-কর্মীকে আটকে রেখে আন্দোলন দমন করার চেষ্টা করেছিল। এতে করে আন্দোলন আরও আরও কঠোর কল রূপ ধারণ করে। ১৯৬৯ সালের ২০ জানুয়ারি পুলিশের গুলিতে আমানুল্লাহ মােহাম্মদ আসাদুজ্জামান নামে ছাত্র ইউনিয়ন মেনন গ্রুপের নেতার একজন নেতার মৃত্যু হলে আন্দোলন প্রকট আকার ধারণ করে। আসাদ হত্যার পরিণতিতে পরিস্থিতি সরকারের নিয়ন্ত্রনের বাইরে চলে যায়। এর আগে ১৮ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড: সামসুজ্জোহা সেনাবাহিনীর বেয়নেট চার্জে মৃত্যুবরণ করেন। পাকিস্তান সরকার নির্যাতন-নিপীড়নের মাধ্যমে আন্দোলন রুদ্ধ করতে গিয়ে এর গতি আরাে তীব্র করে তােলে। ফলে গণঅভূত্থান হয়ে পড়ে অবধারিত।
গণঅভ্যুত্থানের ফলাফলঃ
১৯৬৯ সালের গণআন্দোলন পাকিস্তানের রাজনীতিতে বিশেষ করে বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এ গণআন্দোলনের ফলে বাঙালি জাতীয়তাবাদ সুসংগঠিত হয়ে ওঠে। এ আন্দোলনের ফলে স্বৈরাচার বিরােধী মানসিকতা জনগণের মধ্যে গভীরভাবে প্রােথিত হয়। জনগণ সর্বস্ব ত্যাগ স্বীকারের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত হয়। আন্দোলনের তীব্রতায় আইয়ুব সরকার জনগণের নিকট নতি স্বীকার করে এবং ১৯৬৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে রাওয়ালপিন্ডিতে একটি সর্বদলীয় গােল টেবিল বৈঠক ডাকতে বাধ্য হন।
এ গােলটবিল বৈঠকে তিনটি বিষয়ে নেতৃবর্গ ঐক্যমত্যে পৌছান। যথা- যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসন পদ্ধতির প্রবর্তন, সংসদীয় সরকার ব্যবস্থার প্রবর্তন এবং প্রাপ্তবয়স্কদের ভােটাধিকারের ভিত্তিতে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা। এই অভ্যুত্থানের ফলে মিথ্যা আগরতলা মামলা প্রত্যাহার এবং সকল রাজবন্দীর মুক্তি প্রদান করতে বাধ্য হয় সরকার। এ আন্দোলনের ফলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতির প্রধান নেতায় পরিণত হয়। আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় আইয়ুব খানের স্বৈরাচারী শাসনের পতন ঘটে।
(ঘ) ৭০ এর নির্বাচনঃ
পটভূমিঃ ১৯৬২, ১৯৬৬, ১৯৬৯ সালের উপর্যুপরি আন্দোলনে পাকিস্তান সরকারের অবস্থা ক্রমশ নাজুক হতে থাকে। ১৯৬৯ এর ফেব্রুয়ারিতে গণআন্দোলনের মুখে আইয়ুব খানের পতন ঘটে। ক্ষমতায় আসেন ইয়াহিয়া খান। তিনিও সামরিক শাসন জারি করেন। একই সাথে ঘােষণা করেন, ১৯৭০ সালের ৫ অক্টোবর সার্বজনীন ভােটাধিকারের ভিত্তিতে সারাদেশে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ১৯৭০ সালের ৩০ মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া নির্বাচন সংক্রান্ত আইনবিধি আইনগত কাঠামাে আদেশ’ বা এলএফও ঘােষণা করেন। আইনগত কাঠামাে আদেশ অনুযায়ী জাতীয় পরিষদের নির্বাচনের তারিখ ধার্য করা হয় ৫ অক্টোবর। আর প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনের তারিখ ২২ অক্টোবর স্থির হয়। জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন যথাক্রমে ৭ ও ১৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয়। ১২ নভেম্বর পূর্ব পাকিস্তান উপকূলবর্তী জেলাগুলােতে প্রবল ঘূর্ণিঝড় ও জলােচ্ছ্বাস আঘাত হানে। জলােচ্ছাস প্লাবিত এলাকাগুলােতে ১৯৭১ সালের ১৭ জনুয়ারি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। আইন হয়। আইনগত কাঠামাে আদেশ অনুযায়ী জাতীয় পরিষদের আসন সংখ্যা ৩১৩ নির্ধারণ করা হয়। এর মধ্যে সাধারণ আসন সংখ্যা ৩০০ এবং নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসন সংখ্যা ১৩।
নির্বাচনের ফলাফলঃ
নির্বাচনের ফলাফল ৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত পাকিস্তানের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানে জাতীয় পরিষদের ১৬২ টি আসনের ১৬০ টিতে বিজয়ী হয় আওয়ামী লীগ । বাকি দুটির একটিতে পাকিস্তান ডেমােক্রেটিক পার্টির নূরুল আমিন এবং অপরটিতে স্বতন্ত্র প্রার্থী চাকমা রাজা ত্রিদিব রায় জয়ী হন। আওয়ামী লীগের এই ১৬০ টি আসনের সাথে যুক্ত হয় সংরক্ষিত ৭টি মহিলা আসন। ফলে আওয়ামী লীগের মােট আসন দাঁড়ায় ১৬৭; অর্থাৎ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা। পশ্চিম পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ কোন প্রার্থী দেয়নি। অন্যদিকে কেবল পশ্চিম পাকিস্তানেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জুলফিকার আলী ভুট্টোর পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি)। এ নির্বাচনে উল্লেখযােগ্য দিক হলাে, পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ আওয়ামী লীগ যেমন পশ্চিম পাকিস্তানে কোন আসন পায়নি, তেমনি পশ্চিম পাকিস্তানের সংখ্যা গরিষ্ঠ দল পিপিপি পূর্ব পাকিস্তানে কোন আসন লাভ করেনি।
১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড় ও জলােচ্ছাস ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে ঘূর্ণিঝড় আর জলােচ্ছ্বাসের সংবাদ সর্বপ্রথম ১৪ তারিখে খবরের কাগজে আসে। দিনে-দিনে এর ভয়াবহতা উন্মােচিত হতে থাকে। যা দেখে বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে পড়ে সারা বিশ্ব। পশ্চিমা বিশ্ব থেকে ছুটে আসতে থাকে ত্রাণ কর্মীরা। কিন্তু আসে না শুধু পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার। ত্রাণ সাহায্য দূরের কথা সরকারের পক্ষ থেকে সমবেদনা জানাতেও কেউ আসে নি। এমনকি পশ্চিম পাকিস্তানি রাজনৈতিক নেতারাও এলেন না, মাত্র একজন ছাড়া। তিনি ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ওয়ালী) প্রধান খান আবদুল ওয়ালী খান। কেন্দ্রীয় সরকার ও পশ্চিম পাকিস্তানি নেতাদের এই হৃদয়হীন আচরণ পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটির প্রতি এই অঞ্চলের মানুষের মনে চরম বিতৃষ্ণার জন্ম দেয়। বিতৃষ্ণা ঘৃণায় পরিণত হল ঘূর্ণিঝড় ও জলােচ্ছ্বাসে জীবনহানি সম্পর্কে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রাথমিক রিপাের্ট দেখে। ওই রিপাের্টে মৃতের সংখ্যা মাত্র পঞ্চাশ বলা হল। গভর্নর এস এম আহসানের সংবাদ সম্মেলন বাঙালি মানসে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। ঘূর্ণিঝড় দুর্গত এলাকায় ত্রাণ কাজ পরিচালনার জন্য তিনি হেলিকপ্টার চেয়ে বার্তা পাঠিয়েছিলেন কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে। কিন্তু তাঁকে বিমুখ করা হয়।
১৯৭০ সালের ২৩ নভেম্বর গভর্নর হাউসে (স্বাধীনতার পর বঙ্গভবন) এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি জানান, হেলিকপ্টার চাওয়া হলেও তা পাওয়া যায় নি। কেন্দ্রীয় সরকার ও পশ্চিম পাকিস্তানি নেতাদের এই আচরণে তীব্র ক্ষোভে ফেটে পড়লেন মওলানা ভাসানী ও শেখ মুজিবুর রহমান। শেখ মুজিব ঘূর্ণিদূর্গত এলাকা সফর শেষে এক বিবৃতিতে জানান, সরকার প্রতিটি পর্যায়ে দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে। আবহাওয়া উপগ্রহ মারফত আগাম তথ্য পাওয়া সত্ত্বেও ঘূর্ণিঝড় কবলিত উপকূলীয় বাসিন্দাদের সতর্ক করা ও উদ্ধারের কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। ঘূর্ণিঝড়ের পর মৃতের সংখ্যা অথবা ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণেরও কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
গ) উত্তরঃ- অসহযােগ আন্দোলন এবং বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘােষণা
১৯৭০ সালে অনুষ্ঠিত পাকিস্তানের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। ফলে তারা জনরায়ের ভিত্তিতে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য পাকিস্তানীদের কাছে দাবি জানায়। পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী
১৯৭১ সালের ৩ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করে। কিন্তু এই আহ্বান এর পশ্চাতে গােপনে চলছিল ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র । বাঙালিদের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে না দিয়ে ক্ষমতা আঁকড়ে রাখার ষড়যন্ত্র । হঠাৎ ১ মার্চ ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিতের ঘোষণা দেন। কারণ হিসেবে তিনি দেশের মারাত্মক রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং পশ্চিম পাকিস্তানের কতিপয় নেতা অধিবেশনে অংশ নেবেন না বলে উল্লেখ করেন। এই ঘোষণার পর পর আওয়ামী লীগ প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বলেন, ২৩ বছরের অত্যাচার থেকে মুক্তির জন্য বাঙালিরা এখন যে কোন সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত। অধিবেশন স্থগিতের প্রতিবাদে তিনি সপ্তাহব্যাপী কর্মসূচি ঘোষণা করেন। শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন। ২ ও ৩ মার্চ সারাদেশে হরতাল আহ্বান করা হয়। বঙ্গবন্ধু জানান, ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে আন্দোলনের চূড়ান্ত কর্মসূচি ঘােষণা করা হবে। জনমতের ভিত্তিতে ৬ ও ১১ দফার আলােকে সংবিধান রচনার কথাও তিনি পুনরুল্লেখ করেন। ৩ মার্চ ছাত্রলীগ পল্টন ময়দানের জনসভায় ‘স্বাধীন বাংলাদেশ’ প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে পূর্ণ আস্থা রেখে দল মত নির্বিশেষে স্বাধীনতা সংগ্রাম চালিয়ে যাবার আহ্বান জানায়। সভা শেষে লাখ-লাখ জনতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের সর্বাধিনায়ক হিসেবে মেনে নেয়ার শপথ গ্রহণ করে। ছাত্রলীগের ঘােষণায় রেডিও, টিভি, সংবাদপত্রে আন্দোলনের খবর প্রকাশ করা না হলে তা বর্জনের কথা বলা হয়। এ দিন বঙ্গবন্ধু পুনরায় ক্ষমতা দখলকারী সেনাশাসকদের প্রতি জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর এবং সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফেরত নেবার আহ্বান জানান।
তাকে কঠোর হাতে আন্দোলন প্রতিহত করার নির্দেশ দেন। কিন্তু তঙ্কালীন প্রধান বিচারপতি বি.এ. সিদ্দিকী বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সাড়া দিয়ে টিক্কা খানকে শপথ গ্রহণ করাতে অস্বীকৃতি জানান।
৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে দশ লাখ মানুষের বিশাল জনসমুদ্রে এক ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। এই ভাষণটি বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক ভাষণ। এটি বাংলাদেশের স্বাধীনতার আদি ঘােষণা হিসেবে পরিগণিত হয়।
৮ মার্চ সারাদেশে গেরিলা যুদ্ধের আহ্বান সম্বলিত একটি লিফলেট প্রচারিত হয়। এ দিন ছাত্রলীগ এক জরুরি বৈঠকে “স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্র সগ্রাম পরিষদ গঠনের আহ্বান জানায় । সভায় পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের নাম পরিবর্তন করে ‘ছাত্রলীগ’ ব্যবহার করার প্রস্তাব পাস হয়। সভায় সকল স্থানে পাকিস্তানী পতাকা উত্তোলন, পাকিস্তানী সংগীত বাজানাে ও উর্দু ছবি প্রদর্শন বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
৯ মার্চ কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষ থেকে বলা হয় যে, বঙ্গবন্ধু পূর্ব বাংলায় একটি স্বাধীন ও পৃথক রাষ্ট্র গঠনের যে দাবি উত্থাপন করেছেন তা ন্যায়সঙ্গত। ঐ দিন ‘দৈনিক পাকিস্তান তাদের সম্পাদকীয় মন্তব্যে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের আহ্বান জানায়। পত্রিকাটি আরাে বলে, শেখ মুজিবুর রহমানের দেশ শাসন করার আইনগত অধিকার রয়েছে এবং এক্ষেত্রে সকল বাধা দূর হওয়া উচিত।
| ১০ মার্চ পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত এক জনসভায় মওলানা ভাসানী বলেন, শেখ মুজিবুর রহমান বাংলার বীর। ভাসানী জনতার উদ্দেশ্যে শেখ মুজিবের নির্দেশ মেনে চলার অনুরােধ জানান। এদিন দৈনিক পাকিস্তান’ অবিলম্বে জনপ্রতিনিধিদের
খ্যা সত্যায়ন নােন জানিয়ে মদীয়া মা মন
No comments
thank you